স্মৃতিমেদুর রূপনারায়ণপুর
Hindustan Cable’s Officer’s Association, Rupnarayanpur-এর নতুন website আত্মপ্রকাশের লগ্নে সাহিত্য় বিভাগে আমার প্রথম লেখাটিতে প্রাসঙ্গিকতা অনুযায়ী আমাদের সকলের অতিপ্রিয় রূপনারায়ণপুরকেই তুলে ধরলাম | ফুলের পাঁপড়ির নানান রঙে জারিত স্মৃতির টুকরোগুলো জুড়ে একটি পূর্নাঙ্গ স্মৃতিচারণার রূপদানের প্রয়াস রইল ।
রূপনারায়ণ নদীর নাম পড়েছিলাম ভূগোলে কিন্তু রূপনারায়ণপুরের কথা আগে কখনও শুনিনি | সেই ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের এক সন্ধ্যায় নববধূ হয়ে এখানে আসা – জীবনের সুন্দর দিনগুলোর শুরু আমার এই রূপনারায়ণপুরেই; কৌতুকছলেই জানাই আমার শ্বশুর-মশাইয়ের নামটিও ছিল “শ্রী রূপনারায়ণ মন্ডল” – তাই নদী স্থান ব্য়ক্তি-মানুষ এই ত্রিরূপনারায়ণের মধুর প্রভাব আমার যাপিত জীবনে !
কবিতার মত সুন্দর নামের সাজানো গোছানো জায়গাটাকে ভালোবেসেছি প্রথম দিন থেকেই যদিও ব্য়বসায়ী পরিবারে বড় হওয়া আমার কোন ধারণাই ছিল না colony life সম্পর্কে তাই মনে ছিল সংশয় আবার কৌতূহলও | কিন্তু আমার সমস্ত সংশয় কাটিয়েছিলেন আমার প্রতিবেশিনী বান্ধবীরা | একজন নবাগতাকে ওঁরা যেভাবে স্বাগতম জানিয়েছিলেন তাতে রইল না কোন দূরত্বের অবকাশ – অচিরেই আমি ওদের একজন হয়ে গেলাম |
“Hindustan Cable’s Factory” ও “Hindustan Cable’s Officers’ Colony” গড়ে উঠেছিল বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে | প্রাচীর ঘেরা Factory-এর পাশ দিয়ে পিচঢালা চওড়া মসৃণ রাস্তা, রাস্তার দু’পাশে শিরীষ, শিশু, মহুয়া গাছের দল যারা ডালপালা বিস্তারকরে রাস্তাজুড়ে অপরূপ ছায়াময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল | মাঝে মাঝে স্নিগ্ধ বাতাসে ঝিলমিল জলাশয়গুলি প্রকৃতিতে অনণ্য় মাত্রা যোগ করেছিল | কতদিন ভোরের হাঁটারবেলায় নিষ্কলুষ বাতাস বুক ভরে নিয়েছি, রাত্রিতে নির্জন পথে প্রাচীণ গাছের তলা দিয়ে যাওয়ারকালে আঁধার – অরণ্য় বিচরণের অনুভূতিতে রোমাঞ্চিত হয়েছি ! মূলরাস্তার একদিকে বাগানবেষ্টিত বড় বড় বাংলো, বাগানে সযত্নে লালিত নানান ফুলের সমারোহ |
রাস্তার অন্য়দিকে আমাদের প্রিয় ক্লাব | ক্লাবের পাশের রাস্তা ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছিল যার দু’দিকে গড়ে উঠেছিল Officers’ Colony, D.A.V. Public School ও Married Hostel, দূরে আবছা পাহাড়ের ছায়াঘেরা সাঁওতালী গ্রাম |
রূপনারায়ণপুর প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে অফিসার পরিবারবর্গের সাংস্কৃতিক জীবনচর্চার দিকটি | “Hindustan Cable’s Officers’ Club” ছিল কেবল্স অফিসার পরিবারদের মিলনক্ষেত্র; সাংস্কৃতিক চর্চার প্রাণকেন্দ্র যেখানে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নানা বিষয়ে বহু সুপ্ত প্রতিভার — এই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে ধরাবাঁধা গতানুগতিকতার বাইরে আমাদের মননশীলতা পেত বিভিন্ন ধারায় বয়ে যাওয়ার গতিপথ | সেখানে যেমন ছিল হৈ-হুল্লোড়ের নানান আনন্দ আয়োজন তেমনি ছিল নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা | আনন্দ উৎসবগুলোর কথায় মনে আসে সরস্বতীপূজা, কালীপূজা, পয়লা বৈশাখ উদযাপণ, বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা ও শীতকালীন বনভোজন আয়োজন – সেগুলি সকলের যোগদানে প্রাণবন্ত হয়ে উঠত | বিশেষ আকর্ষণের ছিল হোলি উৎসব – পরষ্পরকে নানান রঙে রাঙিয়ে দেওয়া, গানের অনুষ্ঠান, সকলে মিলে খাওয়া-দাওয়া, একটি রঙীন দিনের মধুর সমাপন | পয়লা বৈশাখের বৈঠকী গানের আসর, নৃত্য়নাট্য় ও নাটকে ছিল সার্বিক যোগদান, নিজেকে মেলে ধরার এই বাতাবরণে নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয় ও লেখনিতে ঘটত নতূন প্রতিভার প্রস্ফুটন |
ক্লাবের অন্য়তম আকর্ষণ ছিলো ‘Bingo’ খেলার দিনগুলো | বিবিধ কুইজ, মেড ফর ইচ্ আদার প্রতিযোগিতা, অন্তাক্ষরী,ফ্যান্সি ড্রেস পার্টি বিবিধ অনুষ্ঠানের নাম কলমের ডগায় ভীড় করে দাঁড়ায় . . .
শেষ করব অবশ্য়ই আমাদের লেডিস ক্লাবের কথা দিয়ে – যেটি ছিলো আমাদের মহিলাদের অত্য়ন্ত প্রিয়স্থান – সাপ্তাহিক Club Day নির্ধারিত ছিল ‘বুধবার’; যে দিনটির জন্য় আমাদের বিশেষ অপেক্ষা রইত |
Club Day-এর বিভিন্ন বিষয়্গুলির মধ্যে আমার প্রথমেই মনে আসে –
- বিতর্ক বা সাম্প্রতিক কোন বিষয়ের উপর নিজের মতামত জানিয়ে কিছুক্ষণ বলা |
- রন্ধন প্রতিযোগিতা – প্রতিযোগিতার দিন টেবিলের উপর সাজানো থাকে সুস্বাদু নানান পদ | এমন সুন্দর তাদের উপস্থাপনা দেখলে মুগ্ধ হয়ে যেতে হোত | ভাবতে ভালোলাগে এত সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপনার এই সুন্দর মানসিকতা ও গুণের অধিকারীণী ছিলেন আমাদের বান্ধবীরা |
- ‘ফেলাছড়ার’ জিনিস দিয়ে তৈরী সামগ্রীর প্রতিযোগীতা – অতি নগণ্য় ও তুচ্ছ জিনিস দিয়ে তৈরী হওয়া হস্তশিল্প যখন প্রতিযোগিতায় নামে তখন তাকে ‘ফেলাছড়া’ বলে কার সাধ্য় ! এইভাবে তৈরী হোত নতুন নতুন উদ্ভাবন, সৃষ্টিশীল মন পেত প্রেরণা |
- আল্পনা প্রতিযোগীতা – অপূর্ব নান্দনিক শিল্পকলার বিচ্ছুরণ ঘটত আল্পনাগুলির সৌন্দর্য্যে |
- গল্প, প্রবন্ধ ও কবিত লেখা – এখানেই আমার লেখনি সত্তার বিকাশ ঘটেছিল | আমার লেখা প্রথম ছোট গল্প “তিতাসের অবকাশ” ক্লাবের পত্রিকায় প্রকাশিত হয় | প্রশংসিত হয়েছিলাম যা আমার পরবর্তী কালে অনুপ্রাণিত করে |
লেডিজ ক্লাবের বড় অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে রসরাজ অমৃত্লাল বসুর “ব্যাপিকা বিদায়” নাটকটির কথা মনে পড়ছে | আমাদের সদশ্য়রাই পুরুষ ও নারী উভয় চরিত্রেই রূপদান করেছিলেন, বিভিন্ন চরিত্রে তাদের অভিনয় মনে রাখার মত | বসন্তোৎসব উদযাপন ছিল আরো এক সুন্দর অভিজ্ঞতা |
লেডিজ ক্লাবের জাঁকজমকপূর্ণ, বর্ণাঢ্য, অত্য়ন্ত আকর্ষণীয় “ফেস্ট” অনুষ্ঠানটি সকলের প্রিয় ছিল | প্রত্যেকেই অপেক্ষা করে থাকতেন এই দিনটার জন্যে – সাজগোজ, খাওয়া-দাওয়া, হই-হল্লা . . . | প্রথমেই reception, তারপর একে একে সুন্দর করে সাজানো স্টলে থরে থরে খাবার-দাবার – দেশী পিঠে, পুলি, মালপোয়া, পান্তুয়া, থেকে শুরু করে বিদেশী কেক, কাটলেট; দক্ষিণভারতীয় ইডলী, ধোসা; এছাড়াও চাট, টিকিয়া, বিভিন্ন রকমের চপ, আলুর দম, ঘুঘনি | সে যেন খাবার-দাবারের সর্বভারতীয় সম্মেলন ! অন্য়দিকে ছিল নানান আকর্ষণীয় খেলা, যেখানে যোগদানকারীদের উপচে পড়া ভীর | সব শেষে ছিল Raffle ও Entry Coupon-এর উপর লটারী ও আকর্ষণীয় উপহার | এইভাবে শেষ হোত একটি বর্ণাঢ্য দিন, আবার অপেক্ষা থাকত আগামী বছরের জন্য় |
এই লেখনির মাধ্য়মে ছেড়ে আসা রূপনারায়ণপুরের আনন্দময় দিনগুলি অন্ততঃ কিছুক্ষণের জন্য়ও ফিরে পাওয়ার প্রচেষ্টা যা টাটকা একঝলক বাতাসের মত আমাদের সোনালী স্মৃতিকে সজীব করে রাখবে |
-শর্মিষ্ঠা মন্ডল