সাল ১৯৭২, রূপনারায়ণপুর
১৩ই ডিসেম্বর, আসানসোল জংশন :
বেলা প্রায় একটা, শীতের মেজাজ বাতাসে, রোদ্দুরে। কুলির মাথায় মাল চাপিয়ে বাইরে এলাম ট্যাক্সির খোঁজে। গন্তব্য রূপনারায়ণপুর।
জিনিষ পত্র চাপিয়ে যখন চলতে শুরু করেছি, এক বয়স্ক ভদ্রলোক, পরনে ধুতি ও সাদা পাঞ্জাবী, ছোট ছোট পাকা চুল, চোখে
মোটা ফ্রেমের চশমা, সুন্দর পরিমিত হাসি, হাত দেখালেন গাড়ি থামাবার জন্য। মনে হল ইংরেজ আমলের এক আগুনে বিপ্লবী আমার সামনে।
— কিছু বলবেন ?
— শুনলাম রূপনারায়ণপুর যাচ্ছেন। আপনি একাই তো ? আমি যেতে পারি ?
একটু ভাবলাম। প্রথম যাচ্ছি, হয়তো কিছু খবর ওঁর কাছে পেতে পারি।
— আসুন, আসুন। গল্প করতে করতে যাব।
— আমি কিন্তু ভাড়া শেয়ার করব।
— না, করবেন না। বসুন তো। পরে দেখা যাবে। আমাকে তো যেতেই হত।
কিন্তু প্রাথমিক আলাপচারিতার পরে বললেন,
— বাঃ, নতুন চাকরি ? খুব ভালো। অভিনন্দন। আপনি ইঞ্জিনিয়ার ?
— ঠিক ধরেছেন। পি & টি ডিপার্টমেন্ট (ডিপার্টমেন্ট অফ টেলিকমিউনিকেশনস এর তখনও জন্ম হয়নি) ছেড়ে এসেছি। ওখানে কয়েক বছর কেবলস এন্ড একুইপমেন্টস মেইনটেনেন্সএ ছিলাম।
— মনে পড়েছে। দেখবেন অনেক নতুন ইঞ্জিনিয়ার জয়েন করবে। HCL এর প্রায় সমস্ত এডভার্টাইসমেন্ট আমারই পাবলিশ করা । আপনাদেরটাও করেছিলাম। আমার অফিস কলকাতায়, মাঝে মাঝে এখানে আসতে হয়। আমার কি মনে হয় জানেন, আপনাকে বোধহয় আর. সেন এর আন্ডারেই দেবে। দেখুন গল্প করতে করতে কেমন চলে এলাম।…. ও ভাই, একটু চেপে দাঁড় করান। আমি এখানেই নামব । ওই যে ডান দিকের বাড়িটা, ওটাই অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিস। আজকে তো আর কিছু হবে না। কালকে আপনাকে এখানেই আসতে হবে। আপনার নতুন যাত্রা শুভ হোক।
ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে, হাসি মুখে, হাত নেড়ে বিদায় নিলেন।
১৫ই ডিসেম্বর :
সব আনুষ্ঠানিকতার শেষে, পার্সোনেল (HR এর তখন আবির্ভাব ঘটেনি) বিভাগের একজন বললেন,
— চলুন, আপনাকে আপনার নতুন কাজের জায়গায় নিয়ে যাই। সবার সঙ্গে আলাপ হয়ে যাবে। কাল থেকে ওখানেই সোজা চলে যাবেন।
একটা ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন। দরজার ফলকে বড় অক্ষরে লেখা আর. সেন। আমার নতুন বিপ্লবী বন্ধুকে মনে মনে সেলাম জানালাম। নিখুঁত অনুমান।
সেন সাহেব তখন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শীর্ষে। কিছু কথা বার্তার পর সেন সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন তার সহকর্মী কল্যাণ ঘোষ সাহেবের কক্ষে। বললেন
—- আরো একজন কল্যাণ কে নিয়ে এলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ কল্যাণময় হয়ে উঠবে।
সুন্দর অভিজ্ঞতা প্রথম দিনে।
সেন সাহেব সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। কল্যাণ ঘোষ সাহেব অনেকদিন আগেই চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। বিপ্লবী বন্ধুর নামটা আজ আর কিছুতেই মনে পড়ছেনা। তবে খবরের কাগজে ওঁর প্রতিষ্ঠান থেকে ওনার মৃত্যু দিবসে ছাপানো ছবি আমার চোখ এড়ায়নি। এই তো সব সেদিনের কথা। রূপনারায়ণপুরে আমার শুরুর প্রধান তিনজনেই আজ অনেক দূরে – ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমি ভুলবনা আপনাদের। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।
১৭ই (রবিবার) / ১৮ই ডিসেম্বর:
সুন্দর শুরু; প্রচন্ড ধাক্কা খেলো হঠাৎই। দুদিন কি তিন দিন বাদে — ঠিক মনে নেই, HCL এ লকআউট ঘোষণা হল। স্ট্রাইক, লকআউট এই সব শব্দ গুলো শুধুই খবরের কাগজে পড়েছিলাম, কোনো ধারণাই ছিল না। এত তাড়াতাড়ি চাক্ষুষ, মুখোমুখি হতে হবে স্বপ্নেও ভাবিনি। তখন আমার কাছে স্ট্রাইক মানে ম্যানেজমেন্টের লোকদের ওপর অত্যাচার ও খুনোখুনি। লকআউট মানে অনেক নিরীহ কর্মীর রাতারাতি চাকরি চলে যাওয়া। কানে বাজত হাওড়া স্টেশনে কম্পার্টমেন্টে ঘুড়ে ঘুড়ে কৌটো বাজিয়ে পয়সা ভিক্ষা করা। দৈনিক পত্রিকায় এসব খবরে সবার জন্যই বেদনা দায়ক খবর হতো।
সেদিন নিজের জন্য তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করেছিলাম । নতুন চাকরি, নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, নতুন পরিস্থিতি, পরিজন থেকে দূরে, বন্ধু বান্ধবহীন নিঃসঙ্গ জীবন, অসহায় লাগছিল। কোথায় পাব একটু আশ্বাস বাণী ? স্বপ্ন কি তবে সব শেষ ? অনভিজ্ঞ মনের নানান বিচিত্র ভাবনা। খুবই বেদনাময় ছিল সেই দিনগুলো।
যাই হোক, সময়ের অদৃশ্য পরশে, তারপর অনেক আনন্দে, কিছু দুঃখে প্রায় ২৩ টা বছর কাটিয়েছিলাম HCL এ।
মানতেই হবে, রূপনারায়ণপুরের বাতাসে জাদু ছিল সবাইকে মধুর বন্ধনে আবদ্ধ করার।
কল্যাণ প্রসন্ন ভট্টাচারিয়া
১৭/০১/২০২১