ফিরে দেখা
প্রান্তীয় বাংলায় অজয় ও দামোদরের মধ্যে যে বিস্তৃত চারণ ভূমি সেই জমি তে হিন্দুস্থান কেবলস কারখানার গোড়াপত্তন হয় ১৯৫২ সালে – উৎপাদন শুরু হয় ১৯৫৪ তে – পাশে রেল নগরী চিত্তরঞ্জন তখন সবে মাত্র পথ চলা শুরু করেছে |
নিকটবর্তী রেল স্টেশন রূপনারায়ণপুর – পূর্ব রেলপথে বাংলার সীমান্ত স্টেশন – কলকাতা থেকে দূরত্ব ২২১ কি.মি. দূরে দিকচক্রবালে ছোট ছোট টিলা, শাল মহুয়া গাছ, সাঁওতাল বস্তি, প্রাকৃতিক পরিবেশ নিঃসঙ্গ সুন্দর – যা মনকে সতেজ করে তোলে |
এই হিন্দুস্থান কেবলস শিল্পভূমির সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার এক উজ্জ্বল ধারাবাহিক ইতিহাস আছে, যার সূত্রপাত মূলতঃ শহর কেন্দ্রিক | যে কোন জনপদ গড়ে ওঠে শিল্পের হাত ধরে | হিন্দুস্থান কেবলসে শুরুতে ও ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল কলোনী ভিত্তিক এক মাঝারি টাউনশিপ, কোম্পানি কোয়ার্টারে বিভিন্ন প্রদেশের লোকেরা এসে বসতি স্থাপন করে | নগরায়ণ প্রক্রিয়ার সাথে সাথে গড়ে ওঠে বিভিন্ন ক্লাব ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল |
ধীরে ধীরে সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার বিকাশ ঘটে | আবাসিকদের চাকরির সাথে সমান্তরাল ভাবে চলতে থাকে সাহিত্য চর্চা, লিটল ম্যাগাজিন, বাৎসরিক সাহিত্য পত্রিকা, কবি সম্মেলন, দেয়াল পত্রিকা | অনেক নামী ও অনামী কবি, লেখকের ভিড়ে প্ৰান্তীয় বাংলার এই শিল্পাঙ্গন সাহিত্যের আমদরবারে নিজের জায়গা করে নেয় |
আমি হিন্দুস্থান কেবলস এর সাথে কর্ম সূত্রে যুক্ত হই ১৯৮১ সালে | ততদিনে কারখানার বয়স ২৭ বছর অতিক্রান্ত | শিল্পাঞ্চলের প্রথম প্রজন্ম অপসৃয়মান – স্থাপিত হয়েছে অফিসার্স ক্লাব, কেবলস ক্লাব, কিশোর সংঘ, নবারুণ সংঘ – বার হচ্ছে অনেক লিটল ম্যাগাজিন, অনেক মুখপত্র |
১৯৭২ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার প্রাপ্ত কবি বিষ্ণু দে কেবলস ক্লাব আয়োজিত বার্ষিক পত্রিকা ‘অর্ঘ্য’ কে লেখা পাঠিয়েছেন :
হিন্দুস্থান কেবলস / রূপনারায়ণপুর
” হ্যাঁ মনে আছে রূপনারানপুরে / নামটাই, কারণ গরম এক দুপুর বেলায়/এক্সপ্রেস ট্রেন থেমে গেলো যেইখানে/আচম্বিতে ! তখন বৈশাখ শেষ প্রায় “
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বরাবরই একটা সাহিত্য সমাজ গড়ে তোলার একান্ত আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন কিছু বুদ্ধিজীবি ও প্রগতি শীল মানুষ | কেবলস এর শুরুতে যাঁরা এই ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁরা হলেন স্বানামধন্য বি কে মিত্র ,এন কে সেনগুপ্ত, বাণী সেনগুপ্তা, এস. কে. রায়, বি. বি. গাঙ্গুলী, দীপক গুপ্ত, এস জে দে, প্রদীপ সেনগুপ্ত, জি আর রেড্ডি, আর. সেন, সি. আর সেন, কল্যাণ ঘোষ, অভিজিৎ গুপ্ত, মলয় সেনগুপ্ত, ডঃ এস. বন্দোপাধ্যায়, মিলন গাঙ্গুলী, শ্যামল গুপ্ত, সুব্রত ঘোষাল, ইন্দ্রজিৎ মল্লিক, সুভাষ চক্রবর্তী, কে. ডি. হোড় ও এন. সি. ঘোষ মহাশয় |
কেবলস অফিসার্স ক্লাব থেকে প্রতি বছর প্রকাশিত হত সাহিত্য পত্রিকা ‘ মনসিজ ‘ | এই প্রসঙ্গে বিশেষ করে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে কেবলস লেডিস ক্লাবের বহু সদস্যা নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করতেন এবং মনসিজ ও স্থানীয় পত্রিকায় লেখা দিতেন | এছাড়া বাংলার প্রতিষ্ঠিত অনেক লেখক এই পত্রিকায় নিয়মিত লেখা দিতেন | প্রায় ই সাহিত্য আসর বসতো অফিসার্স ক্লাব অডিটোরিয়াম এ | মনে পড়ে আগস্ট ১৯৯৪ এ বেশ বড়ো আকারে কবি সম্মেলন হয়েছিল সেই ক্লাবে | এসেছিলেন সাহিত্যিক কিন্নর রায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, ভগীরথ মিশ্র, নলিনী বেরা | তার কয়েক বছর আগে এসেছিলেন নীরেন চক্রবর্তী, সন্তোষ ঘোষ, সুনীল গাঙ্গুলী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, নিমাই ভট্টাচার্য |
আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে পার্সোনেল ডিপার্টমেন্ট থেকে দেয়াল পত্রিকা ‘ কর্ণিক ‘ প্রকাশ করতাম, যেখানে কারখানার অনেকেই লেখা দিতেন | মনে পড়ে কবি অরুণ চট্টোপাধ্যায় প্রায়শই অফিসে আসতেন কবিতা নিয়ে | দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের দিন উনি বেশ কয়েকবার উপস্থিত ছিলেন | সেই দেয়াল পত্রিকা ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল |
অফিসে যারা নিয়মিত লেখার চর্চা করতেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য মলয় সেনগুপ্ত ও শ্যামল গুপ্ত মহাশয়, সুদীপ্ত মাধব বাসু, কানুপ্রিয় চট্টরাজ, ডঃ নির্মাল্য দেব মান্না, আনন্দ ময় সরকার |
সাহিত্য চর্চার সাথে যাঁরা নিয়মিত যুক্ত ছিলেন তাঁরা হলেন কেবলস স্কুলের জয়া মিত্র (আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্ত) মৃগাঙ্ক শেখর দত্ত, কুমুদ মণ্ডল , হরিশংকর চট্যোপাধ্যায়, সমীর সেন,শচীন দে, প্রশান্ত মল্ল, মানিক চন্দ্র দাস, রানা মুখোপাধ্যায়, পীযুষ গাঙ্গুলী, গৌর বাউরি, অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ বিশ্বাস, যামিনী চন্দ | আজ এই সাহিত্যিক দের অনেকেই না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন | ¢L¿¹¥ একটা সময়কে ধরে রাখা আছে তাঁদের লেখনীতে |
এই প্রসঙ্গে আর একজনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন – পাবলিক রিলেশনস ডিপার্টমেন্টের বাসুদেব মণ্ডল | তাঁর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কারখানার কয়েক জন সহকর্মীর সাথে ১৯৮৪ সাল থেকে মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘আজকের যোধন’ নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশ করে চলেছেন — তার ই প্রচেষ্টায় বর্ধমান জেলা লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন ‘মুক্ত মঞ্চে’ ১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত হয় |
ক্রমে ক্রমে কারখানার অস্তিত্বের সংকট প্রকট হয়ে ওঠে | ধীরে ধীরে কবিতার বাতিঘরে আলো নিভে আসে | তারপরের ইতিহাস কারো অজানা নয় | হিন্দুস্থান কেবলস এখন স্বপ্নের মতো জেগে থাকে স্মৃতির আঘ্রাণে জীবনের বিহান বেলায় |
কানুপ্রিয় চট্টরাজ